'হাজার তরুণ এর আদর্শ এক বারুন!'
স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে খবর:- ১৯৯৯-২০০২ সালের মধ্যে ১২ টি খুন ও ৩৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার গোবরডাঙ্গার পাশে একটি গ্রাম সুঁটিয়াতে।
পশ্চিমবঙ্গের এই সুঁটিয়া গ্রাম কে তখন বলা হত ‘ধর্ষনগ্রাম'।
মানুষ অতিষ্ট হয়ে ২০০২ সালের ১ আগস্ট সুঁটিয়া বাজারে ডাক দেওয়া হলো প্রথম প্রকাশ্য এক প্রতিবাদসভার। অনেকেই এসেছে, তবুও বক্তৃতা করার সাহস কেউ পাচ্ছে না।
এগিয়ে এলেন এক যুবক, মাইকটা তুলে নিয়ে বললেন,“যদি এখনও মা-বোনেদের সম্মান রক্ষা করতে না পারি, তা হলে আমরা সভ্য সমাজে থাকার যোগ্য নই। আমাদের যদি ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে, তাহলে আমাদের তাদের থেকেও বেশি শাস্তি পাওয়া উচিত…তাই আসুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের নারীদের সম্মান রক্ষা করুন।”- আমি বরুণ বিশ্বাস বলছি।
কে এই বরুণ বিশ্বাস ?
- আপনারা অনেকেই হয়তো চেনেন আবার অনেকেই হয়তো চেনেননা।
১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা) সুটিয়ায় বরুণ বিশ্বাসের জন্ম। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবা-মা জগদীশ বিশ্বাস ও গীতা বিশ্বাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফরিদপুর থেকে চব্বিশ পরগনা জেলার পাঁচপোতার আচারিপাড়ায় চলে এসেছিলেন। জগদীশ বিশ্বাস তাঁর সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য দিনে মজুরের কাজ করে ও রাতে স্থানীয় যাত্রাদলে গান গেয়ে জীবিকানির্বাহ করতেন।
বরুণ বিশ্বাস পাঁচপোতা ভরাডাঙা হাই স্কুল ও খাতরা বয়েজ হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও নিউ ব্যারাকপুরের বি. টি. কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা শেষ করার পর বরুণ বিশ্বাস WBCS পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কিন্তু সমাজসেবা ও শিক্ষকতার জীবন বেছে নেন।
১৯৯৮ সালে তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে (মেন) স্কুলশিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই শিক্ষকতা করেছিলেন। - সেইসময় স্কুল-শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস একদল গ্রামবাসীদের নিয়ে এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি জানাতে থাকেন। ২০০০ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি অন্যান্যদের সঙ্গে "সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ" গঠন করেন। শয়তানদের দুর্গ কেঁপে উঠল। ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’এর আন্দোলনের চাপে ধরা পড়লো পাঁচজন অপরাধী।
আসামী সুশান্ত চৌধুরীর হাতে বরুন তুলে দিয়েছিলেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’। বলেছিলেন “জেলে বসে পড়িস।” - শক্তিশালী করা, নিজের খাট দান করে নিজে প্লাস্টিকে শোয়া,অন্যের পড়াশুনার খরচ চালানো, বিভিন্ন অসুবিধা তে সরকারকে চিঠি মারফৎ জানানো, রাতে মানুষদের পাহারা দেওয়া প্রভৃতির নেপথ্যে ওই মানুষটা ছিলেন। স্নাতক পাস বেকার তরুণদের একত্র , বরুণ থাকবে।
৩৯ বছর বয়সে ২০১২ সালের ৬ জুলাই, গোবরডাঙ্গা স্টেশনের পাশে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন সুটিয়া গণধর্ষণ-কাণ্ডের প্রতিবাদী মঞ্চের নেতা, শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস মানে গ্রামের সবার প্রিয় বরুণ দা।
মৃত্যুর এক বছর পর বরুণ বিশ্বাসের জীবন-সংগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিচালক রাজ চক্রবর্তী 'প্রলয়' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত করেছেন।
এছাড়াও একই বছরে পাঁচপোতার দূর্গাপূজা মণ্ডপের নাম দেওয়া হয়েছিলো বরুণ মঞ্চ এবং মণ্ডপসজ্জা করা হয়েছিলো তাঁর জীবনালোকে।
(স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে খবর)
0 মন্তব্যসমূহ